বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নতুন মহাসচিব নিযুক্ত হয়েছেন ইংল্যান্ড প্রবাসী সাবেক শিবির নেতা আবদুল আউয়াল মামুন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে এই পদের জন্য মনোনীত করেন দলটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তবে এখন দলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে আছেন নুরুল কবির ভূঁইয়া পিন্টু।
সূত্র জানায়, নতুন মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন গত মাসে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেন। এরপর তাকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করেন দলের চেয়ারম্যান।
এ প্রসঙ্গে কল্যাণ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নুরুল কবির ভূঁইয়া পিন্টু বলেন, ‘আমাদের মহাসচিব বিদেশে আছেন। দলে যোগদানের প্রায় দেড় বছর আগে থেকেই চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। তার অনুপস্থিতিতে আমি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে কাজ করছি। দেশে এলে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তবে এখন ভার্চুয়ালি তিনি দলের কার্যক্রমে যুক্ত হন।’
কল্যাণ পার্টির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার কাছে জানা গেছে, গত ১০ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে নতুনভাবে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী যোগ দিয়েছেন দলে। তাদের মধ্যে প্রায় অধিকাংশ সদস্য জামায়াত ও শিবির থেকে আসা। মাঝে তারা কিছুদিনের জন্য এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি) ঘুরে এসেছে।
দলের নতুন মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন ইংল্যান্ডে সপরিবারে বসবাস করছেন। ২০০৬ সালে তিনি দেশটিতে যান। আবদুল আউয়াল মামুন কল্যাণ পার্টিতে যোগদানের আগে ‘জামায়াত-শিবির’ ছেড়ে আসা নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনটির সহকারী সদস্য সচিব ও সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল করা হয়েছিল তাকে।
কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘স্থানিক দূরত্ব এখন খুব একটা বেশি সমস্যা করে না। কারণ ভার্চুয়ালি দলের সভায় যোগ দেওয়া যাচ্ছে সহজেই। সারাবিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত।’
দেশের বাইরে কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দল ও দেশকে কূটনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে চান আবদুল আউয়াল মামুন। ইংল্যান্ডে থেকে এ বিষয়টি তত্ত্বাবধান করতে পারছেন তিনি। আগামী মাসে দেশে ফেরার ইচ্ছে আছে তার।
নিজের রাজনৈতিক জীবন প্রসঙ্গে আবদুল আউয়াল মামুন জানান, তিনি চট্টগ্রাম কলেজ জীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাংস্কৃতিকভাবে খেলাঘর আসরের সঙ্গে কাজ করেছেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিবিরে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে তিনি সংগঠনটির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।
যদিও আবদুল আউয়াল মামুনের দাবি- মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত হওয়ায় তিনি কখনও জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলাননি।
কল্যাণ পার্টির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে মামুনের কথা, ‘আমাদের এখন মূল উদ্দেশ্য হলো ফরোয়ার্ড থিংকিং ও সল্যুশন ফোকাস।’
নতুন মহাসচিব নিয়োগ প্রসঙ্গে দলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব. সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের ভাষ্য, আবদুল আউয়াল মামুন গত ১৭ বছর ধরে কোনও ধরনের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন। এরপর কোনও রাজনীতি করেননি।
দেশে এখন রাজনৈতিক সংকট রয়েছে উল্লেখ করে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। তাই আমরা চাই দেশের বিবেকবান মানুষ ও তরুণ যুবারা রাজনীতিতে আসুক।’
কল্যাণ পার্টির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে, এমন একাধিক দলের নেতারা দাবি করেছেন, কল্যাণ পার্টির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বোঝাপড়া ভালো। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ না পেলে কল্যাণ পার্টির প্রতীককে কাজে লাগাতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠনটি।
জামায়াতে ইসলামীর পল্টন থানা শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বর্তমানে কল্যাণ পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আলী হোসেন ফরাজী (দাঁড়িয়ে)
জামায়াতে ইসলামীর পল্টন থানা শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বর্তমানে কল্যাণ পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আলী হোসেন ফরাজী (দাঁড়িয়ে)
আরেকটি সূত্রের দাবি, জামায়াতের সঙ্গে কল্যাণ পার্টির রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। নানান সুবিধা আদান-প্রদান ও বিএনপি-জোট থেকে শেষমেষ বাদ পড়লে দলটির মার্কা নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার বিষয়টিও এর মধ্যে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানের জবাব, ‘কল্যাণ পার্টিকে অবমূল্যায়ন করতে এ ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমরা ২০ দলীয় জোটে ছিলাম, জোটের শরিক হিসেবে সবার সঙ্গে যেটুকু সম্পর্ক থাকার কথা সেটুকুই রয়েছে। পার্টির অবমূল্যায়ন ও বদনাম করতে এসব আলোচনা করা হচ্ছে।’
একই প্রসঙ্গে নতুন মহাসচিবের মন্তব্য, ‘আমার সঙ্গে জামায়াতের ব্যক্তিগত কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের দেশে বাস্তবতার চেয়ে কল্পনাই বেশি হয়। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী আগে জামায়াত করতেন; এরকম আরও প্রমাণ হয়তো দেওয়া যাবে। এখন যদি বলা হয়, আওয়ামী লীগ দখলের পরিকল্পনা করছে জামায়াত তাহলে তা মনে হবে হাইপোথেটিক্যাল কথা।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কল্যাণ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তত ১১ জন নেতা আছেন যাদের সবাই জামায়াত ও শিবিরের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। এর মধ্যে দলটির যুগ্ম মহাসচিব নুরুল আফসার ফেনী জেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি, ভাইস চেয়ারম্যান জাকিউল হক জাকি জামায়াতের ঢাকা মহানগরের সাহিত্য বিভাগে এবং ভাইস চেয়ারম্যান আলী হোসেন ফরাজী পল্টন থানা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে কাজ করেছেন।
সম্প্রতি যোগ দেওয়ার মধ্যে পার্টির বর্তমান যুগ্ম-মহাসচিব (সমন্বয়কারী) আবদুল্লাহ আল হাসান সাকিব শিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের ছাত্র কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রামে ‘হামজা ব্রিডেগ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক হয়েছিলেন তিনি। আটককালীন ছবি নিজের ফেসবুকেও শেয়ার করেছেন।
দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর উত্তর মহানগর সভাপতি নাজমুল হুদা অপু সিলেট এমসি কলেজ শিবিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির আরও বেশ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময় জামায়াত ও শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন।
কারও ক্ষেত্রে সূত্রের দাবি, জামায়াত-শিবির করে এসে কল্যাণ পার্টিতে যোগ দিলেও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠন জামায়াতেও ‘রুকন’ হিসেবে রয়েছেন বেশ কয়েকজন। এমনকি জামায়াতে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করছেন কয়েকজন। পুরো প্রক্রিয়া জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মনিটর করছেন, এমনটাই দাবি কল্যাণ পার্টির প্রভাবশালী একজন সাবেক নেতার।
কল্যাণ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে কল্যাণ পার্টির কোনও রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। কল্যাণ পার্টি একটি রাজনৈতিক দল, এই দলে বাংলাদেশের নাগরিকরা যোগ দিতে পারেন। কারা আগে কী দল করেছেন তা তো বিবেচ্য না। আর আমি এটা জানিও না।’