মামলায় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বেশকিছু নির্দেশনা রয়েছে। ঐসব নির্দেশনা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পাতায় থাকলেও তা পালনে খুব একটা সচেষ্ট নয় অনেক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। শুধু ম্যাজিস্ট্রেটই নন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও রিমান্ড আবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিও নির্দেশনা রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের। কিন্তু বিভিন্ন মামলায় তদন্ত কর্মকর্তারা রিমান্ড আবেদন দিলেই অনেক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও আইনজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন।
সম্প্রতি মাদক মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দফায় দফায় রিমান্ডে পাঠানোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ হাইকোর্ট। তিন দফায় ঐ চিত্রনায়িকার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলেছে, তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন দিল আর বিচারক (ম্যাজিস্ট্রেট) সেই আবেদন মঞ্জুর করে দিলেন, এটা সভ্য সমাজে চলতে পারে না। দফায় দফায় রিমান্ডে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তার বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
পরীমনির রিমান্ড মঞ্জুরের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের দ্বৈত বেঞ্চ গতকাল বুধবার এই মন্তব্য করেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোস্তফা জামান বলেন, ‘রিমান্ড মঞ্জুর করা, না করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটরা ঐসব নির্দেশনা মানছেন না। ঐ নির্দেশনা না মেনে ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না।’
গত ৪ আগস্ট রাতে বনানীর ১২ নম্বর রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ পরীমনিকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা তিন দফায় ১৯ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ম্যাজিস্ট্রেট তিন দফায় সাত দিন পুলিশ রিমান্ডে পাঠায়। রিমান্ড শেষে গত ২১ আগস্ট পরীমনিকে কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাল তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর আগে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী। ঐ আবেদনের শুনানিতে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, রিমান্ড সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ে যেসব নির্দেশনা আছে সেগুলো অধস্তন আদালতের বিচারকদের মেনে চলতে বলা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের মামলা ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা মেনে চলা হয় না। আদালত বলেন, রিমান্ড বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা যাতে প্রতিপালন করা হয় সেজন্য একটা গাইডলাইন দেওয়া জরুরি। রিমান্ড নিয়ে আপিল বিভাগের গাইডলাইন থাকার পরেও ম্যাজিস্ট্রেটরা তা মানছেন না। ঐ গাইডলাইন অনুসরণ করার জন্য আদালত আদেশ দিতে পারেন।
আদালত বলেন, পরীমনির দ্বিতীয় দফার রিমান্ড কত দিনের ছিল? পরীমনির আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, দুই দিন। প্রথম রিমান্ড ছিল চার দিনের। তৃতীয় দফার রিমান্ড ছিল এক দিনের।
রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি) মিজানুর রহমান বলেন, পরীমনির জামিন শুনানি দ্রুত করার প্রশ্নে রুল তো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আদালত বলেন, একটা অংশ নিষ্পত্তি হয়ছে। আরেকটা অংশ আছে।
‘মামলার রেকর্ড কল করে দেখব’
বিচারপতি মোস্তফা জামান বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পরীমনির রিমান্ডের রেকর্ড আমরা কল করতে পারি। উনি (ম্যাজিস্ট্রেট) একটা জবাব দিক। যদি তা সন্তোষজনক না হয় তাহলে তলবের আদেশ দেব। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি) মিজানুর রহমান বলেন, জামিনসংক্রান্ত রুলটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
বিচারপতি মোস্তফা জামান বলেন, মহানগর দায়রা আদালত জামিন আবেদন কত দিনের মধ্যে শুনবেন সেটা নিয়ে গাইডলাইন দেব। কারণ জামিন আবেদন এক মাস পরে নাকি দুই মাস পরে, নাকি তিন দিন পরে শুনবেন ঐ আদালত।
এএজি বলেন, পরীমনির রিমান্ডের ওপর কি আদালত রুল ইস্যু করতে চাচ্ছেন? বিচারপতি মোস্তফা জামান বলেন, রুল ইস্যু করতে চাচ্ছি না, রিপোর্ট কল করতে চাচ্ছি। তাদের (ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে কি ম্যাটেরিয়াল (উপাদান) ছিল যে তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।
এএজি বলেন, এখন তো পরীমনি রিমান্ডে নেই। বিচারপতি বলেন, রিমান্ডে নেই ঠিক আছে, কিন্তু কেস ডকেটে (সিডি) কি ম্যাটেরিয়াল ছিল যে তিন বার রিমান্ডে দিল? কেন ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড ক্ষমতার অপ্যবহার করলেন? এই মামলায় চার দিন রিমান্ডের পরে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি না, তদন্তকারী কর্মকর্তা, কেস ডকেটসহ (মামলার নথি) কোর্টে অ্যাপিয়ার করতে বলব। এরপর এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন বলে সময় চান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল। তখন পরীমনির আইনজীবীর কোনো আপত্তি না থাকায় মামলাটি আজ শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছে আদালত।