চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)-এর একজন নিম্নপদস্থ গাড়িচালক কীভাবে শতকোটি টাকার মালিক হলেন—এমন বিস্ময়কর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন নাগরিক মহলে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিডিএর গাড়িচালক মহিউদ্দিন সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলেছেন বিশাল অবৈধ সম্পদের সাম্রাজ্য। তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে জমি, দোকান, ফ্ল্যাট, সঞ্চয়পত্রসহ নানা মূল্যবান সম্পদ। এসব আয় একজন সাধারণ কর্মচারীর পক্ষে আইনি বা বৈধভাবে অর্জন একেবারেই অসম্ভব বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র মতে, সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় সিডিএর একটি শপিং মহলের তৃতীয় তলায় ২৫/বি নম্বর দোকানটি মহিউদ্দিন তার স্ত্রী লাকী আক্তারের নামে ক্রয় করেন। দোকানটির মূল্য ২৬ লাখ ৩১ হাজার ৪৪৭ টাকা। এ ছাড়া ফিরিঙ্গীবাজার মৌজায় তিন কাটা জমি কেনেন তিনি, যার ওপর ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়েছেন সিডিএ থেকে (বি.সি. কেইস নং-৭৮৯/০২/২০২১-২০২২)।
অভিযোগ রয়েছে, সিডিএ অফিস ভবনের নিচতলায় চউক কো-অপারেটিভের একটি দোকান নিজের ভাইয়ের নামে বরাদ্দ করলেও প্রকৃত মালিক মহিউদ্দিনই। একইভাবে স্ত্রীর নামে পূবালী ব্যাংকের সিডিএ শাখায় বড় অঙ্কের সঞ্চয়পত্রও রয়েছে।
‘অনন্যা আবাসিক’ প্রকল্পে কর্মচারী কোটায় একটি প্লট বরাদ্দ পান মহিউদ্দিন। যদিও এটি দীর্ঘমেয়াদী কিস্তির ভিত্তিতে পরিশোধ করার কথা ছিল, তিনি এককালীন অর্থ পরিশোধ করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থের উৎস ছিল অবৈধ উপার্জন।
সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আ. হ. ম. মিছবাহ উদ্দিনের নামে বরাদ্দকৃত সরকারি পাজেরো (চট্টমেট্টো-ঘ-১১-১২৯৬) গাড়িটি চালান মহিউদ্দিন। অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিসিয়াল ডিউটির বাইরে গাড়িটি তিনি ব্যবহার করেন পারিবারিক নানা কাজে—স্ত্রীর বাপের বাড়ি যাতায়াত, সন্তানদের ড্রাইভিং শেখানো, পারিবারিক ভ্রমণ, এমনকি বেআইনি ভবনের সাইট ভিজিটেও।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি এই গাড়ি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্ল্যান পাসের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করেন। প্রকৌশলীর গাড়ি দেখে অনেকেই তার কথায় বিশ্বাস করে ঘুষ দিতে বাধ্য হন।
সরকারি চাকরির সীমিত আয়ের বাইরে মহিউদ্দিন নিজে হজ পালন করেন এবং তার পিতাকেও হজে পাঠান। স্ত্রীর চিকিৎসার অজুহাতে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এসব ব্যয়বহুল কার্যক্রমের আর্থিক উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিডিএর একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের একাধিক দাপুটে নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করে জমি ছাড়পত্র, নকশা অনুমোদন ও প্লট বরাদ্দের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। বিশেষ করে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এবং এম. জহিরুল আলম দোভাষের সময়ে তার অপকর্মের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়।
এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের আন্দোলন দমনেও সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। চকবাজার, কোতোয়ালী ও চান্দগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আ. হ. ম. মিছবাহ উদ্দিন বলেন, “ড্রাইভার মহিউদ্দিন অফিসে আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত। তবে অফিস সময়ের বাইরে তিনি গাড়ি ব্যবহার করেন কি না, তা আমার জানা নেই। তাকে সতর্ক করা হবে।”
সিডিএর প্রশাসন বিভাগের সচিব রবীন্দ্র চাকমা জানান, “মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আমাদের কাজ সহজ হবে।”
অভিযোগের বিষয়ে ড্রাইভার মহিউদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তাকে লিখিতভাবে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারীর নামে এ ধরনের সম্পদের পাহাড় থাকা দুর্নীতির প্রমাণ বহন করে। সরকারি যানবাহনের অপব্যবহার এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ দণ্ডবিধি ও দুঃসাচরণবিরোধী আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত দ্রুত তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
মহিউদ্দিনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মচারী যখন প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন, তখন প্রশ্ন উঠে—ব্যবস্থার কোথায় ত্রুটি? এই ঘটনা শুধু সিডিএ নয়, গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে তুলে ধরে।