1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০২:০৯ অপরাহ্ন

রাজধানীতে লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা হকারদের রক্ত চুষে খাচ্ছে

রিপোর্টার
  • আপডেট : শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪
  • ৮৭ বার দেখা হয়েছে

এম রাসেল সরকার:

রাজধানীর গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকা, এখানকার দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার সড়ক ঘিরে ফুটপাত, সড়ক এবং অলিগলির রাস্তায় অন্তত আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার দোকান বসে প্রতিদিন। একই জায়গায় দিন-রাত বিভিন্ন শিফটে ভাগ হয়ে বসে হরেকরকম পণ্যের এসব দোকান। এজন্য দৈনিক ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় একেকজন হকারকে।

গড়ে দুইশ টাকা করে দিলেও তিন হাজার দোকান থেকে দৈনিক ছয় লাখ টাকা ওঠে। মাসিক হিসাবে যার অঙ্ক দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বছরের পর বছর ফুটপাত ও হাঁটার রাস্তায় বসছে এসব দোকান। কখনো কখনো পুরো রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকান বসিয়ে। রাজনৈতিক নেতা, একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলছে ফুটপাত ও রাস্তা ভাড়ার এই মহাবাণিজ্য।

এই চিত্র শুধু গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকার নয়। ঢাকার প্রায় সব এলাকাতেই একই চিত্র বিরাজমান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটপাত, সড়ক ও ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গায় ছোট চৌকি, বস্তার চট কিংবা ভ্যানের ওপর ব্যবসা করছেন আড়াই লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এদের থেকে চাঁদা তোলেন পাঁচ শতাধিক লাইনম্যান ও তাদের সহযোগী। একই স্থান দৈনিক দুই থেকে পাঁচবারও বিক্রি হয়। এজন্য একেকজন হকারকে গুনতে হয় ৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

রাতের দোকানগুলোতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। এজন্য বেশিরভাগ জায়গায় রাতের শিফটে দোকান দেওয়ার জন্য ৫০ টাকার মতো বেশি দিতে হয়। এভাবে মাসে ফুটপাত ও রাস্তা ভাড়া দিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য চলে রাজধানীতে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। যা চলে যায় দখলবাজ সিন্ডিকেটের পকেটে। সরকারের কোষাগারে এর একটি পয়সাও যায় না। এই বাণিজ্য ঘিরে প্রায়ই খুন, হামলা, সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এমএ কাশেম বলেন, ফুটপাত এখন সোনার খনি হয়ে গেছে। এখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগ বলে কথা নেই। যারাই দুর্বল তাদের ওপর আঘাত করা হয়। রাজধানীতে এখন আড়াই লাখের বেশি হকার রয়েছে। লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা হকারদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ এসবে শেল্টার দেয়। এভাবে মাসে শতকোটি টাকার চাঁদা ওঠে। মাঝে মাঝে দু-চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর দেখি তারা বের হয়ে আবার একই কাজ করে। যদি দুই সিটি করপোরেশন প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিত, তাহলে এমন অবস্থা হতো না। সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে থাকত।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোতে ভিড়েছেন অনেকে। আধিপত্য বিস্তারে ফুটপাত কিংবা সরকারি জমিতে ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠন কিংবা বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠনের নামে স্থাপন করা হয়েছে কার্যালয়। বাইরে থেকে দলীয় কার্যালয় মনে হলেও এসব ঘিরেই চলছে চাঁদাবাজি।

কিছু কিছু এলাকায় অনেকটা স্থায়ীভাবেই দখল করা হয়েছে ফুটপাত, সড়ক এবং ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গা। আগে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া দিলেও নগরীর অনেক জায়গায় এখন এসব স্থানকে ‘পজিশন’ হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। জায়গার গুরুত্বভেদে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকায় একেকটি পজিশন বিক্রি হচ্ছে। আর এই সুযোগে ফুটপাতে দুর্বল ব্যবসায়ীদের তুলে দিয়ে দখলবাজরা মোটা অঙ্কের টাকায় পজিশন বিক্রি করে দিচ্ছে।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার ফুটপাত বিক্রি বা লিজদান ও ভাড়া উত্তোলনে জড়িতদের তালিকা প্রস্তুত করে আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ফুটপাত বিক্রি ও ভাড়া উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই নির্দেশনার পরও ঢাকার ফুটপাত ও সড়কের চেহারা বদলায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) বলেন, রাজধানীর ফুটপাত দেখাশোনার মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাদের সঙ্গে পুলিশ বিভিন্ন সময়ে এসব দোকানপাট উচ্ছেদে কাজ করেছে। যখন তাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়, তারা এসে আবার বসে। দশকের পর দশক এভাবেই চলছে।

ফুটপাত দখলে পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু পুলিশ নয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ আছে। সুনির্দিষ্টভাবে এমন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এরই অংশ হিসাবে রেডজোন, ইয়োলো জোন ও গ্রিন জোন-এই তিন ভাগে ফুটপাত চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি জানান, পুরো হকারমুক্ত থাকবে। ইয়োলো জোনে একটা নির্ধারিত সময়ে হকার বসবে। আর গ্রিন জোনে হকার বসতে পারবে। এখানে সিটি করপোরেশনের কোনো বাধা থাকবে না।

লাইনম্যান ও নিয়ন্ত্রক কারা : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত লাইনম্যানরা হকারদের থেকে মাঠপর্যায়ে টাকা উঠিয়ে উপরে পৌঁছে দেন। এজন্য তাদের দোকানপ্রতি কিংবা গড়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। তাছাড়া দোকানে কেউ সমস্যা করছে কিনা, দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে মধ্যস্থতাও করেন তারা। কোনো কিছু নিয়ে বিপাকে পড়লে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীকে ডাকেন তারা। সিটি করপোরেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনো ফুটপাত উদ্ধারে অভিযানে গেলেও এই লাঠিয়ালরাই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। বিক্ষোভ-ভাঙচুরের অগ্রভাবে থাকেন তারা।

জানা যায়, এলাকা ভাগ ভাগ করে শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন গডফাদাররা। এমন গডফাদার গুলিস্তানে চার, সদরঘাটে তিন, নিউমার্কেটে তিন, মতিঝিলে তিন, ফার্মগেটে তিন, মিরপুর-১ নম্বরে দুই, মিরপুর-১০ নম্বরে দুই, উত্তরায় দুই, বাড্ডায় দুই, কুড়িলে দুজন রয়েছেন।

নিউমার্কেট এলাকার এক ব্যবসায়ী নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক হকারদের রক্ত চুষে ডেমরার সানারপাড়ে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি তৈরি করছেন। এই এলাকার এমন কয়েকজনকে চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। তাদের বাইরে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু নেতা চাঁদা তোলেন। এদের উৎপাত সারা বছরই সইতে হয়। এর বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।

গুলিস্তান খদ্দের মার্কেট এলাকার এক হকার বলেন, ‘এখানে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করি। ব্যবসা না করলে খাব কী? আমাগো নাম লিখবেন না, লিখলে কাল থেকে আর বসতে দেবে না।’ গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, উত্তরা ও পুরান ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও একইরকম তথ্য দেন।

পুলিশের মতিঝিল বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ‘দীর্ঘদিন তারা ফুটপাতে দোকান দিয়ে এখন এটাকে নিজেদের জায়গা মনে করে। পুলিশ ছাড়াও অনেক মানুষ এর সুবিধাভোগী। উচ্ছেদ অভিযান করতে গেলেই উপর থেকে তদবির আসা শুরু হয়। বিক্ষোভ হয়। এজন্য মাঝে মাঝে কিছু অভিযান করলেও কার্যকরভাবে তা করা হয় না। যেহেতু তারা বসবেই এজন্য স্থানীয় পুলিশের অনেক সদস্যও হকারদের থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নেন।’

স্থানীয় হকাররা জানান, বায়তুল মোকাররম জিপিও লিংক রোডে হলিডে মার্কেটে খোকন মজুমদার, আবুল হাসেম, মজিবর, পোটল, নসু, হারুন ও তার সহযোগীরা চাঁদা আদায় করে। উত্তরগেট এলাকায় দুম্বা রহিম, সাজু চাঁদা তোলে। শাপলা চত্বরে আরিফ; পল্টনে দুলাল ও তার সহযোগী; গুলিস্তানে আহাদ পুলিশ বক্স ও রাস্তায় আমিন, সাহিদ ও লম্বা হারুন; জুতাপট্টিতে সালেহ; গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে ঘাউড়া বাবুল ও শাহীন টাকা তোলে।

এ ছাড়া ওসমানী উদ্যানের পূর্ব ও উত্তর অংশে লম্বা শাজাহান; গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটের পশ্চিমে কাদের ও উত্তরে হান্নান, পূর্বে সালাম, আক্তার ও জাহাঙ্গীর; গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় লাইনম্যান সর্দার বাবুল; সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় লম্বা বাবুল, পূর্বপাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া; মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে মো. আলী, আবদুল গফুর ও বাবুল ভুঁইয়া; শাহবাগে ফজর আলী, আকাশ, কালাম ও নুর ইসলাম; যাত্রাবাড়ীতে সোনা মিয়া, তোরাব আলী, মান্নান টাকা তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। জুরাইন-পোস্তগোলায় খায়রুল, সিরাজ তালুকদার ও গরু হানিফ; লালবাগে আবদুস সামাদ, চানমিয়া ও ফিরোজ; মিরপুর-১ এ ছোট জুয়েল, আলী, বাদশা ও মিজান; মিরপুর-১১-এ আবদুল ওয়াদুদ, শফিক ও হানিফ; গুলশানে হাকিম আলী; কুড়িলে আবদুর রহীম ও নুরুল আমিন; এয়ারপোর্টে আকতার, মনির, ইব্রাহিম, জামাল ও বাবুল; উত্তরায় টিপু, নাসির ও হামিদ চাঁদা তোলে।

মিরপুর এলাকাটির সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনাসহ বিভিন্ন দোকানপাট। এছাড়া ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল স্টেশন, ওভারব্রিজ, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির, মার্কেট, সরকারি-বেসরকারি স্কুলের খালি জায়গা ও উন্মুক্ত স্থানও চলে গেছে কয়েক হাজার হকার আর দোকানিদের দখলে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারদলীয় লোকজন, সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ওয়ার্ড কাউন্সিলর, বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন, স্থানীয় কথিত কয়েক সাংবাদিক ও মিরপুর বিভাগের কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যরা এই সড়ক ও ফুটপাতের নিয়ন্ত্রক। সরেজমিন মিরপুর ১, ২, ১০, ১২, ১৩, ১৪, ভাষানটেক, সেনপাড়া, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কালশী, গাবতলী ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

সরেজমিন দেখা যায়, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, ১০ নম্বর শাহ আলী মার্কেট, ফায়ার সার্ভিস, হোপ স্কুলের গলিসহ আশপাশের সড়কের অর্ধেকই চলে গেছে হকারদের দখলে। কিছু জায়গায় ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল সড়কেও বসানো হয়েছে দোকান। মিরপুর ১০ নম্বর হোপ স্কুলের গলির প্রায় সাড়ে ছয় হাজার দোকান থেকে উঠানো হয় মাসিক চাঁদা। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, দলীয় নেতাকর্মী, পুলিশ মিলে নিয়ন্ত্রণ করছে সড়কটি। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিকের নিয়ন্ত্রণে হোপ স্কুলের সড়কটি। স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘মাইনকা মার্কেট’ও বলা হয়।

এ ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিলর বলেন, আমার ওয়ার্ডে সড়ক ও ফুটপাতে কিছুদিন পরপর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। আমি সব সময় দখলবাজদের বিরুদ্ধে। আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ সড়ক ফুটপাত দখল করলে তার নাম বলেন আমি ব্যবস্থা নেব।

মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর, চিড়িয়াখানা রোড, সনি সিনেমা হল থেকে ঈদগাহ মাঠ, স্বাধীন বাংলা মার্কেট, খলিল ভবন, নাছিম বাজার থেকে আল নূরী মসজিদ, স্বাধীন বাংলা মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, সিটি করপোরেশন মার্কেট, বাগদাদ, মুক্ত বাংলা শপিং কমপ্লেক্স, শাহ আলী গার্লস কলেজসহ আশপাশের গলির ফুটপাতে প্রায় ৪ হাজার হকারের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

এসব ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন লাইনম্যানরা। তাদের সহযোগিতায় রয়েছে বেশ কয়েকটি লাঠিয়াল বাহিনী। প্রতিপক্ষ গ্রুপের দখল ঠেকানো ছাড়াও কেউ ফুপটাতের টাকা দিতে না চাইলে তাদের পেটানো এ গ্রুপের কাজ। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানান, এ অংশের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হলেন জনৈক কবির ওরফে ফুট কবির।

হকাররা জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের এক নেতার নাম ভাঙিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর ফলপট্টির দুই শতাধিক দোকান নিয়ন্ত্রণ করেন জনৈক যুবলীগ নেতা। দোকানভেদে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা আদায় করেন তার নিয়োগকৃত লাইনম্যানরা। মিরপুর-২ ও গ্যালাক্সি হাসপাতাল থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত শতাধিক দোকানে চাঁদা নেন জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা আখের ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া মাসুমের লোকজন। মিরপুর ১০ নম্বর ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনে থেকে স্টেডিয়ামের আশপাশ ঘিরে দুই শতাধিক দোকানের নিয়ন্ত্রক যুবলীগ নেতা। এই টাকা কালেকশন করেন লাইনম্যান সাইফুল।

মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট : এই তিনটি এলাকায় ফুটপাত দখলের উৎসব চলছে। সরেজমিন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় দেখা যায়, মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডের পাশের সড়ক দখল করেই গড়ে তোলা হয়েছে অঘোষিত হাটবাজার। বিকাল হলেই অঘোষিত এই হাটবাজারে কয়েক হাজার দোকানপাট মূল সড়ক থেকে শুরু করে গলিপথগুলোও দখল করে নেয়।

মোহাম্মদপুরের আল্লাহ করীম থেকে তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত সড়কটির প্রতি দোকান থেকে অগ্রিম বাবদ ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়। পাশাপাশি, প্রতিদিন ভাড়া বাবদ তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা আদায় করা হয়। ময়ূর ভিলা ইউনিট আওয়ামী লীগের জনৈক সহসভাপতি লাইনম্যান রেখে প্রতি দোকান থেকে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করেন। টাউন হল এলাকাজুড়ে রাস্তা দখল করে ভ্রাম্যমাণ ফাস্টফুডের দোকান থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার সবই প্রতিনিয়ত বসে রাস্তা দখল করে।

এছাড়া শ্যামলী হল থেকে শুরু করে সূচনা কমিউনিটি সেন্টার, কৃষি মার্কেটের আশপাশ হয়ে প্রিন্স বাজারের সামনেও বসছে দোকান। শিয়া মসজিদ, টপ টেনের সামনে থেকে জাপান গার্ডেন, নূরজাহান স্কুলের সামনে হয়ে শেখেরটেক এলাকা পর্যন্ত রাস্তা দখল করে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বসছে। এই এলাকায় স্থানীয় জনৈক যুবলীগ নেতায় লাইনম্যান রেখে চাঁদার টাকা কালেকশন করছেন।

ধানমন্ডি এলাকাজুড়ে ফুটপাত দখল করে নার্সারি ব্যবসা ও ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট ছড়িয়ে পরেছে। শংকর থেকে আবাহনী মাঠ ও আশপাশের এলাকাজুড়ে রাস্তার ওপর থাকা ফুটপাত দখল করে নার্সারি বসানো হয়েছে। এসব নার্সারি বসাতে প্রতিটি দোকান থেকে অগ্রিম বাবদ ৫০ হাজার টাকা এবং মাসিক ভড়া বাবদ ৮-১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়।

এছাড়াও, ধানমন্ডি ইবনে সিনা, কেয়ারি প্লাজা ও ঝিগাতলা বাস স্ট্যান্ডসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বসিয়ে দখল করা হয়েছে। এসব এলাকায় প্রতিটি দোকান থেকে অগ্রিম বাবদ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। প্রতিদিন লাইনম্যান ও ভাড়া বাবদ দোকান প্রতি তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা আদায় করা হয়।

সিটি কলেজ ও নিউমার্কেট এলাকাজুড়ে ফুটপাত ও রাস্তা দখল হওয়ায় মানুষের হাঁটার রাস্তা নেই বললেই চলে। নিউমার্কেটের ফুটপাতের চাঁদা উত্তোলনে দায়িত্ব পালন করছে অন্তত ২০ জন লাইনম্যান। এছাড়াও, পুলিশের টাকা কালেকশন করতে লাইনম্যান হিসাবে কয়েকজন নিয়োজিত রয়েছে। চাঁদনী চক মার্কেটের সামনে ফুটপাত দখল করে প্রায় শতাধিক দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। এই এলাকায় প্রতি চার হাত দোকানের বিপরীতে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা অগ্রিম বাবদ দিতে হয়। প্রতিদিন দোকান বাবদ একশ থেকে দেড়শ টাকা এবং পুলিশের খরচ বাবদ লাইনম্যান হিসাবে পরিচিত ঝন্টু চাঁদা আদায় করে।

এ এলাকার পাশাপাশি, গাউসিয়া সুপার মার্কেট, নূরজাহান মার্কেট ও বলাকা হলের সামনের ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে চাঁদার টাকা তুলে লাইনম্যান খ্যাত ছাত্তার। পাশাপাশি, গ্লোব শপিং সেন্টার, ঢাকা কলেজ থেকে সিটি কলেজ পর্যন্ত চাঁদার টাকা তোলে ইভু নামে আরেক লাইনম্যান। সে প্রতি দোকান থেকে পুলিশের টাকা বাবদ সাড়ে ৫শ টাকা চাঁদা আদায় করে।

ডিএমপি ট্রাফিক রমনা বিভাগের এডিসি জানান, এ ফুটপাত নিয়ে আমরা যখন অভিযান চালাই, তখন হকাররা দোকান তুলে নেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার দোকানপাট বসানো শুরু করে।

যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী : এই এলাকার ফুটপাত, রাস্তার ওপর অবৈধ দোকানপাট, অবৈধ সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা এমনকি ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তায় পার্কিংয়ের সুবাদে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় চলে এসব চাঁদাবাজি। যাত্রাবাড়ী মোড়ে শেখ রাসেল পার্কের সামনে ফুটপাত ও রাস্তার জায়গা দখল করে প্রায় ৩ শতাধিক দোকানপাট গড়ে উঠেছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠে।

হকাররা জানান, ক্ষমতাসীন দলীয় সংগঠনের পাশাপাশি থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও প্যাট্রোল পুলিশের কতিপয় সদস্যের পকেটে এর ভাগ যায়। এছাড়া যাত্রাবাড়ী শহীদ ফারুক রোড, যাত্রাবাড়ী দোলাইরপাড় সড়কে ছামাদ সুপার মার্কেটের সামনে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দুই শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে।

হকাররা জানান, কদমতলী থানার জুরাইন মেডিকেল রোড থেকে বিক্রমপুর প্লাজা পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় দেড়শ দোকান রয়েছে। এখানে দোকানের আকারভেদে প্রতিদিন ১০০ থেকে আড়াইশ টাকা এবং মাছের দোকান থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করেন হানিফ নামের এক ব্যক্তি। জুরাইন রেললাইন থেকে সেতু মার্কেট পর্যন্ত প্রায় ১০০ দোকান থেকে চাঁদা আদায় করেন শ্রমিক লীগের নামের এক নেতা। এখানে প্রতি দোকান থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। জুরাইন আলম মার্কেট থেকে সেতু মার্কেট পর্যন্ত প্রায় ৫০ দোকান থেকে প্রতিদিন প্রতি দোকান থেকে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেন। জুরাইন ফ্লাইওভারের নিচে সরকারি জায়গায় প্রায় ৫০-৬০টি হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি করছে মোশারফ।

কদমতলী থানা এলাকায় শনিরআখড়া জিয়া সরণি সড়কে আবেদিন মার্কেটের কোনা থেকে জাপানি বাজার পর্যন্ত সড়ক ও ফুটপাত দখল করে প্রায় তিন শতাধিক দোকান রয়েছে সড়কের দুপাশে। প্রতি দোকান থেকে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। খড়া আবেদিন ভবন থেকে ব্যাংক এশিয়া পর্যন্ত জনৈক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জীবন দাস প্রায় শতাধিক দোকান থেকে আড়াইশ টাকা করে চাঁদা নেন।

হকাররা জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বিধান, ব্যাংক এশিয়া থেকে দনিয়া কলেজ পর্যন্ত প্রায় ৬০ দোকান থেকে জাকারিয়া রাসেল এবং বর্ণমালা আদর্শ স্কুল রোডে প্রায় ৪০-৫০ দোকান থেকে দুইশ টাকা থেকে ৩শ টাকা করে চাঁদা নেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬১ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেলোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক হানিফ।

শনিরআখড়া আন্ডার পাসের নিচ থেকে উত্তর পাশে মৃধাবাড়ি সড়কে ফুটপাত ও সড়ক দখল করে তিন শতাধিক দোকান বসেছে।

পুরান ঢাকা: এই এলাকার ব্যতস্তম সড়কগুলোতে বসানো হকার ও স্ট্যান্ডকে ঘিরে মাসে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও ট্রাফিক পুলিশ মিলে দোকান এবং গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করছে।

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ট্রাফিক) বলেন, কোনো ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি