1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : জাতীয় অর্থনীতি : জাতীয় অর্থনীতি
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩৫ অপরাহ্ন

ভোজ্য তেল হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়ছে সূর্যমুখী ফুলের

আরএম সেলিম শাহী,
  • আপডেট : বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১
  • ৪২৩ বার দেখা হয়েছে

শেরপুর : সূর্যমুখী শুধু দেখতেই রুপময় নয় গুণেও অনন্য। সূর্যমুখী বীজের তেল স্বাস্থ্যের জন্য অতুলনীয়। পুষ্টিগুণে অন্যসব তেলবীজের তুলনায় বেশি উপকারী। অন্যান্য তেলবীজে স্বাস্থ্যের জন্য যেসব ক্ষতিকারক উপাদান থাকে, সূর্যমুখীতে তা নেই। বরং উপকারী উপাদান ও পুষ্টিগুণ বিদ্যমান।

পুষ্টি বিজ্ঞানের মতে, সূর্যমুখী তেলে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ উপকারী ফ্যাট থাকে। মানব দেহের জন্য উপকারী ওমেগা-৬, ওমেগা-৯ তো আছেই; আছে ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও মিনারেল। চমৎকার এনার্জির উৎস এ সূর্যমুখী তেল। অন্যান্য তেল বেশীদিন সেবনে ক্যানসার, ডায়াবটিস ও হ্রদরোগের ঝুকি বাড়ে। পক্ষান্তরে সূর্যমুখীর তেল মানব দহের জন্য উপকারী হওয়ায় এ দেশে দিন দিন সূর্যমুখীর দিকে কৃষকরা ঝুঁকছেন। ভোজ্য তেল হিসিবে এই তেলবীজের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

এরই মধ্যে পার্শবর্তী দেশ ভারত সহ উন্নত দেশগুলোতে সূর্যমুখীর তেল বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমরা বিদেশ থেকে ভোজ্য তেল আমদানি করি, দেশে যে পরিমাণ তেলবীজ জাতীয় ফসল চাষ করা হয়, তাতে চাহিদার তুলনায় অতিনগন্য। আমরা যদি দেশীয়ভাবে সূর্যমুখীর বীজকে প্রাধান্য দিয়ে তা থেকে তেল সংগ্রহ করি, তাতে অন্যান্য ক্ষতিকর ভোজ্য তেলের চেয়ে বেশী পুষ্টিকর ও সুস্বাস্থ্যকর সূর্যমুখী তেলের চাহিদা মিটবে। সূর্যমুখী বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ। এতে মানবদেহের জন্য উপকারী লিনোলেনিক এসিড থাকে শতকরা ৬৮ভাগ। আমাদের তেল সংক্রান্ত জটিল সব অসুখের হাত থেকে মুক্তি পেতে, খাবারে তেলের ব্যবহার বন্ধ করতে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহার করতেই হচ্ছে, তাই অন্যান্য তেলে ক্ষতিকর উপাদান বেশি থাকায় সূর্যমুখীর তেল হতে পারে আমাদের জীবনের জন্য আশীর্বাদ।

দেশের প্রায় সব এলাকাতেই সূর্যমুখী চাষ করা সম্ভব। উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম থাকায় এবং বাজারে দাম ভালো থাকায় ও বেশ চাহিদা থাকায় কৃষকরা এ ফসল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। বাড়ির আশেপাশের পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে পরিবারের দৈনন্দিন ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। আমন পরবর্তী পতিত জমিতে সহজেই সূর্যমুখী করে বিঘাপ্রতি বছরে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। সূর্যমুখীর খৈল মাছ এবং গবাদী পশুর খাদ্য হিসাবে ও কান্ড জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সয়াবিন চাষে যেখানে ১৩০ দিন লাগে, সেখানে সূর্যমুখী চাষে লাগে মাত্র ১০০ দিন।

তাছাড়া, সরিষার চেয়ে ফলন বেশী এবং সয়াবিনের চেয়ে ফলন সামান্য কম হলেও সূর্যমুখীতে তেলের পরিমাণ সয়াবিনের চেয়ে দ্বিগুণ। বর্তমানে সূর্যমুখী তেলবীজের মণ প্রতি স্বাভাবিক বাজার মূল্য এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। প্রতি শতাংশ উৎপাদিত ১২ কেজি সূর্যমুখী বীজ থেকে ৪ লিটার তেল ও ৮ কেজি খৈল পাওয়া যায়। তেল সর্বনিম্ম ১৪০ টাকা লিটার ও খৈল ৩০ টাকা কেজি হিসাবে যার বাজার মূল্য ৮০০ টাকা। শতাংশ প্রতি ২৩০ টাকা উৎপাদন খরচ ও ১২০ টাকা তেল ভাঙ্গানো খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা লাভ হয়।

সূর্যমুখীর খৈল গবাদি পশু, হাঁস মুরগি বা মাছের খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিকর। ফসল কর্তনের পর সূর্যমুখীর কান্ড ও পুষ্পস্তবক জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া পরিকল্পিত ভাবে লাইন আকারে চাষ করলে সূর্যমুখী গাছের লাইনের ফাঁকে লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা প্রভৃতি স্বল্পমেয়াদী শাক-সবজি আন্তঃফসল ফসল হিসেবে চাষ করে অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব বলে জানান মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি অফিসারগন।

উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের পোলাদেশী গ্রামের চাষী আব্দুল হালিম, কিতাবালী হাজী, বাছুরআলগার বাদল মিয়া, মোকসেদ আলী মাস্টার, পাঠাকাটার রনজু মিয়াসহ অনেকে জানান, সূর্যমুখী চাষে কয়েকগুণ লাভ হয়, তাই তারা অন্যান্য ফনল ছেড়ে এই তেলবীজ জাতীয় ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। আগামীতে তারা এই ফসলের আবাদ আরও বাড়াবেন বলে তারা জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কৃষিবিদ মাহমুদুল হাসান মুসা জানান, সূর্যমুখী তেল হৃদরোগীদের জন্য খুব উপকারী। এ ছাড়া সূর্যমুখী তেল মানুষের রক্তের কোলেস্টোরল ও উচ্চ রক্ত চাপ কমাতে সাহায্য করে। প্রচুর পরিমাণ প্রাণশক্তি থাকায় সূর্যমুখী বীজের তেল আমাদের শরীরের দুর্বলতা কাটাতে অত্যন্ত কার্যকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে রান্নার জন্য অন্যসকল তেলের চাইতে সূর্যমুখীর তেল প্রায় দশগুণ বেশী পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। স্বাস্থ্য সচেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইদানিং ভোজ্য তেল হিসেবে সূর্যমুখী ক্রমেই বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে।

অন্যএক কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, প্রথমে উচ্চবিত্তরা এর ভোক্তা হলেও বর্তমানে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্তদের মধ্যেও এ তেলের ব্যবহার বাড়ছে। এদেশে সূর্যমুখী তেলের চহিদা পূরণ করতে আমদানি করতে হচ্ছে। বাজারে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ কম থাকায় অন্যান্য তেল বেশী ব্যবহার করতে হচ্ছে। বাজারে সরবরাহ থাকলে এ তেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকে। এদিক বিবেচনায় কৃষিবান্ধব সরকার সূর্যমুখী চাষের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় গত বছরের তুলনায় ৫ গুণেরও বেশি জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রোকসানা নাসরীন জানান, গত বছর উপজেলায় ১৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছিলো। কিন্তু এবছর আবাদ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮৫ হেক্টর। তিনি জানান, অল্প ব্যয়ে ও নাম মাত্র শ্রমে সূর্যমুখী চাষে কৃষকরা অধিক লাভবান হওয়ায় এ আবাদের দিকে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এবছর কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্ভাসন কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার ও সূর্যমুখী বীজ বিতরণ করায় এ তেলবীজ জাতীয় ফসলে কৃষকের আগ্রহ কয়েকগুণ বেড়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, বাংলাদেশ সাধারনত বারি সূর্যমুখী-২, বারি সূর্যমুখী-৩ ও বাংলাদেশে প্রচলিত হাইব্রিড জাত প্যাসিফিক হাইসান-৩৩ বেশি চাষ করা হয়। হেক্টর প্রতি এর উৎপাদন ২.৭৫ মেট্রিকটন থেকে ৩ মেট্রিকটন। সূর্যমুখী সারা বছর চাষ করা যায়। তবে মধ্য নভে¤¦র থেকে মধ্য ডিসেম্বরে চাষ করলে ভালো ফলন হয়। খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে মাসেও এফসল চাষ করা যায়। এ দুই মৌসুমে সূর্যমুখী চাষ করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। তিনি জানান, কৃষি অফিসারের পরামর্শক্রমে সঠিক সময়ে বিঘা প্রতি ইউরিয়া ২৫ থেকে ২৭ কেজি, টিএসপি ২৩ থেকে ২৫ কেজি, এমপি এবং জিপসাম ২০ থেকে ২৫ কেজি, জিংক সালফেট ১.৩৫ কেজি ও গোবর ১.২ টন ব্যবহার করলে সূর্যমুখীর ফলন ভালো হয়।

কৃষি অফিসার আরও জানান, এবছর জেলার ৩ সহস্রাধিক কৃষকের মাঝে এক বিঘা করে জমিতে সূর্যমুখী চাষের জন্য কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্ভাসন কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে সার ও সূর্যমুখী বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে, নকলা উপজেলায় প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ১২০ কৃষককে ও পুনর্ভাসন কর্মসূচির আওতায় ৫০০ কৃষককে বীজ ও সার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দেশের চাহিদার ২০ ভাগ মসলা ও ভোজ্য তেল দেশে উৎপাদন হয়, চাহিদার বাকি ৮০ ভাগ আমদানী করতে হয়। এতে প্রচুর টাকা বিদেশে চলে যায়। তাই দেশের টাকা দেশে রাখতে মসলা ও তৈলবীজ জাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। এরজন্য কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি অফিস। অন্যান্য ফসলে চেয়ে লাভ বেশি পাওয়ায় আগামীতে সূর্যমুখীর আবাদ কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশাব্যক্ত করে এ কৃষি অফিসার।

Please Share This Post in Your Social Media

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© ২০২০ দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি